ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ইন্টারনেট গণমাধ্যমের বিকাশ

rifaat newaz
Published : 30 Oct 2016, 02:00 PM
Updated : 30 Oct 2016, 02:00 PM

সংবাদপত্রের ইতিহাস ও বিবর্তনে এই উপমহাদেশ এক অনন্য উর্বর ভূমি। দিকদর্শন, বেঙ্গল গেজেট, সমাচার দর্পণ ইত্যাদি সংবাদপত্রের মাধ্যমেই উপমহাদেশে সংবাদমাধ্যমের যাত্রা শুরু হয় উনিশ শতকের শুরুতে। আর মাত্র তিন দশক পরেই 'রঙ্গপুর বার্তাবহ' দিয়ে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু হয়। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা এ দেশের মানুষের চিন্তা ও মননে পরিবর্তন এবং সমাজের অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এমনকি বাঙ্গালির মুক্তি অর্জনেও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা কল্যাণকামী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু সময়ের আবর্তে এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের বিকাশ ও সাংবাদিকতার নিজস্বতা প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশও সেই পরিবর্তনে পিছিয়ে নেই। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সেই পরিবর্তনের অগ্রপথিক। আর সেই পরিবর্তনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত ও তারই আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টার নির্দেশনায় পরিচালিত কার্যক্রম তথা ডিজিটাল বাংলাদেশের সার্বিক কার্যক্রম।

বাংলাদেশে সংবাদপত্রের বিচরণ ও বিকাশ শুরু হয়েছিল পৃথিবীর অনেক নামী-দামি পত্রিকারও আগে। আজ বিশ্বময় পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, যুক্তরাজ্যের দ্য সান ও দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ইত্যাদি জগদ্বিখ্যাত পত্রিকাগুলোর যাত্রাও আমাদের সংবাদপত্রের যাত্রার পর। দীর্ঘ এই সময়ে বিশ্বময় যেমন সংবাদ প্রকাশ ও পরিবেশনে পরিবর্তন এসেছে, তেমনি পরিবর্তন এসেছে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারে। কাগজ থেকে কম্পিউটার, কম্পিউটার থেকে মোবাইল ফোন, দীর্ঘ এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমের বৈশ্বিক বিবর্তনের ধারায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম যেন আলোকবর্তিকা। নিজেরা শুধু তথ্যবহুল ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদই প্রচার করছে না, অন্যান্য মিডিয়াকে দৃপ্তিময় এবং বাংলাদেশে নিউ-মিডিয়ার বিকাশে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আরেকটি বিষয় স্পষ্ট যে, সংবাদপত্রগুলো ক্রমান্বয়ে মাসিক, সাপ্তাহিক, দৈনিক ও বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে তা ডিজিটাল পোর্টাল ও অ্যাপে রূপান্তরিত হয়েছে। আগে একজন পাঠককে সর্বশেষ সংবাদ জানার জন্য ন্যূনতম চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হত। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে ইলেকট্রনিক মিডিয়া দিনকে ঘণ্টায় রূপান্তর করেছিল। বর্তমানে ইন্টারনেট মিডিয়ার কল্যাণে সে ঘণ্টাও এখন সেকেন্ডে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের খবর জানা এখন অনেকটা নিজের ইচ্ছা ও জানার আগ্রহের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই যুগোপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের পথিকৃৎ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। দেশের প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম শুধু প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নতুন ধারার গণমাধ্যমই নয়, সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় নতুন প্রজন্মের তথ্যবহুল সংবাদ জোগানোরও এক অনন্য হাতিয়ার বটে।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট গণমাধ্যমের বিস্তার ও বিকাশের পরিক্রমায় আজকের এই অবস্থান কিন্তু এক দিনে তৈরি হয়নি। আজ থেকে প্রায় আট বছর পেছনে তাকালে এই বাংলাদেশেই আমরা কী দেখতে পাই? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দেওয়ার আগেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের যাত্রা শুরু হলেও সকল ইন্টারনেট মিডিয়ার বিকাশ ও প্রসার কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম বাস্তবায়নের পর থেকে। কারণ, বিপণন ব্যবস্থার কার্যকর চ্যানেল ছাড়া আপনি শুধু একটি অবকাঠামো বা সেবা বা পণ্য উৎপাদন করলেই যেমন তার শেষ রক্ষা হয় না, তেমনি শুধু উচ্চমানের অনলাইন মিডিয়া ও ওয়েবসাইট করলেই এর প্রসার লাভ হয় না। অনেক প্রতিষ্ঠান শেষ অবধি প্রত্যাশিত পর্যায়ে যেতেও পারে না বা টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ডিজিটাল অবকাঠামো ও নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা যখন থেকে আমরা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে শুরু করেছি, তখন থেকেই ইন্টারনেট মিডিয়ার উন্নয়ন, বিস্তার ও বিকাশ ঘটতে শুরু হয়েছে, বেড়েছে পাঠক সংখ্যাও।

আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে এবং তার আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে ইতোমধ্যে আমরা উপজেলা পর্যায়ে ফাইবার অপটিক কেবল পৌঁছে দিয়েছি, কম্পিউটার ও কম্পিউটার যন্ত্রাংশ এবং হার্ডওয়ারের ওপর যৌক্তিক পর্যায় পর্যন্ত ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৩ কোটি মোবাইল সিম ব্যবহৃত হচ্ছে, ৬ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ইন্টারনেটে সংযুক্ত হয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে কেবল ডিজিটাল বাংলাদেশে নামক দীর্ঘমেয়াদি এক বিপ্লবী স্বপ্নের বাস্তবায়ন পরিক্রমায়। আর সেই যাত্রায় ইন্টারনেট মাধ্যমে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের রূপরেখায় তাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম গর্বিত অংশীদারও বটে।

মানুষের সহজাত প্রবৃতি হল সহজ উপায়ে সর্বশেষ ও নির্ভুল তথ্য জানতে চাওয়া। এই সহজাত ঝোঁক এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও অনুপম অগ্রগতির ফলে দিনে দিনে ইন্টারনেট নিউজ পোর্টালের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা জ্যামিতিক হারে অব্যাহত আছে। অনেক সময় দেখা যায়, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও অনলাইন মিডিয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে। আজকাল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে রিপোর্টিংয়ে পরিবর্তন এসেছে এবং সে পরিবর্তন চলমান রয়েছে। এছাড়া অনলাইনের এই জোয়ারে টিকে থাকতে ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে মূলধারার সব পত্রিকা তাদের অনলাইন ভার্সন চালু করেছে। অনেক মূলধারার বিশ্বখ্যাত পত্রিকা যেমন দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, শিকাগো ট্রিবিউন তাদের কাগজে ছাপানো পত্রিকা বন্ধ করে শুধু অনলাইন ভার্সনে চলে এসেছে। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমানে সাড়া জাগানো ভূমিকা রাখছে। সব সময় হয়তো ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে, তা বলা যাবে না। কিন্তু মূলধারার জার্নালিজমের সাথে এই সোশ্যাল মিডিয়াও দিনে দিনে এক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া একান্ত চিন্তাভাবনা ও মত প্রকাশের এক অসাধারণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

আমাদের দেশে দিনে দিনে ইন্টারনেট জার্নালিজম জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, মানুষের মাঝে সাড়া জাগাচ্ছে। ইন্টারনেট জার্নালিজম সাড়া জাগানোর বেশ কিছু বিবেচ্য বিষয় রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হল এটি অনেক বেশি ইন্টারঅ্যাকটিভ। এখানে চাইলে টেক্সট-অডিও-ভিডিও আকারে সংবাদ পরিবেশন করা যাচ্ছে। সুযোগ থাকছে সাধারণ মানুষের ফিডব্যাক দেওয়ার। অর্থাৎ ইন্টারনেট মিডিয়া গতানুগতিক মিডিয়ার মতো একমুখী না হয়ে দ্বিমুখী যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। ইন্টারনেট মিডিয়া যেমন গণমাধ্যম হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতিটি অনুষঙ্গের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছে তেমনি জনগণও তার মতামত দেওয়ার মাধ্যমে তার ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করছে। পাশাপাশি, সাধারণ মানুষের মতামতকে কেউ গুরুত্ব না দিলে পাঠক আর সেই সাইটে বসে থাকছে না। সে অন্য কোনো পোর্টালে ব্রাউজ শুরু করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে পরিতৃপ্ত না ততক্ষণ পর্যন্ত সে এভাবে খুঁজতেই থাকে। টিকে থাকার স্বার্থে তাই ইন্টারনেট মিডিয়াগুলোকে অনেক বেশি সংগ্রামে রত থাকতে হয়, পাঠকবান্ধব হতে হয়। এভাবে ক্রমাগত উন্নতির দিকে নিজেরাও ধাবিত হতে সচেষ্ট হয়, নতুবা পরিসমাপ্তি অবধারিত। একদিন এই পৃথিবীর কেউ কল্পনাও করেনি যে হাই-ফাইভ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, নোকিয়ার মতো কোম্পানির কোণঠাসা হওয়া লাগবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মানসম্পন্ন ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের ফলে এই পোর্টালটি যেমন পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে তেমনি তাদের অনুকরণ ও অনুসরণ করেই এদেশে অনেক অনলাইন পোর্টালের জন্ম হয়েছে যা অত্যন্ত ইতিবাচক। কিন্তু কিছু ওয়েবসাইট গুণ-মান অনেক সময় খেয়াল রাখছে না। আমি সব সাংবাদিক ভাইবোনের প্রতি আহ্বান জানাব, আপনারাও এ বিষয়ে সজাগ থাকুন। সরকার এ বিষয়ে কাজ করছে। গণমাধ্যমের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং সত্যিকারের গুণী সাংবাদিকদের সম্মান সমুন্নত রাখতে সরকার অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নে অধিক মনোযোগ দিয়েছে। পাশাপাশি সাইবার স্পেসে যাতে কোনো নাগরিক হয়রানির শিকার না হয়, কেউ যাতে প্রতারণা করে পার পেয়ে না যায় এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামো ও ডিজিটাল নেটওয়ার্কের যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে যাতে বাংলাদেশের ক্রমান্বয়ে ডিজিটাল ইকোনমির পথে রূপান্তরের যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত না করতে পারে, সেজন্য আমরা 'ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৬' করতে যাচ্ছি, যা ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে।

দ্রুত সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে যাতে সংবাদের মান ক্ষুণ্ণ না হয় এবং ভুল তথ্য উপস্থাপিত না হয়, সে বিষয়ে বরাবরই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সজাগ ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এই দীর্ঘ পরিক্রমায় তাদের সে আস্থা সমুন্নত করতে পেরেছে। সঠিক, সময়োপযোগী ও তথ্যবহুল সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম একদিকে নিজের ভিত মজবুত করেছে, অন্যদিকে মজবুত করছে সমাজ, গণতন্ত্র, সুশাসনের ভিত। এছাড়া দৃঢ় করছে মানবিকতা, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, কৃষ্টি ও বাঙ্গালি সংস্কৃতি। আর ডিজিটাল বাংলাদেশেরও অন্যতম লক্ষ্য হল তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ও কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনীতি সুদৃঢ় করা, দারিদ্র্য কমানো, মানুষকে কর্মক্ষম করা ইত্যাদি।

এটা অত্যন্ত আনন্দের যে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম পরিবর্তনের বিষয়ে সব সময়ই বেশিমাত্রায় শুধু ওয়াকিবহালই নয়, বরং নিজ উদ্যোগেও নতুন নতুন ফিচার চালু করেছে। শিশুদের জন্য হ্যালো, সাধারণ নাগরিকদের জন্য সিটিজেন জার্নালিজম, চিন্তার খোরাক জোগাতে ব্লগ ইত্যাদি বিষয়ের সন্নিবেশ করেছে। পাঠকের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি তাদের বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করছে।

এটা প্রমাণিত যে, বর্তমান বিশ্বে যার কাছে যত সঠিক ও উপযোগী তথ্য-উপাত্ত থাকবে, সে-ই তত বেশি সমৃদ্ধ। তাই সহজেই বলা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এক পরীক্ষিত অনুষঙ্গ। ইন্টারনেট জার্নালিজমেও অগ্রপথিক।

আমি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এর সব পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীকে শুভেচ্ছা জানাই। ধন্যবাদ জানাই এর সংবাদ কর্মীদের।

জুনাইদ আহ্ মেদ পলক এমপি
রাজনীতিক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী