অনলাইন সাংবাদিকতার স্কুলে সাড়ে ৬ বছর

rifaat newaz
Published : 30 Oct 2016, 09:50 AM
Updated : 30 Oct 2016, 09:50 AM

দশ পেরিয়ে এগার বছরে পা রাখছে দেশের প্রথম অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। আমারও এখানে দেখতে দেখতে সাত বছর হতে চলল।

২০০৯ সালের এ রকম এক অক্টোবরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের অফিসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসাবে কাজ করতে এসেছিলাম। প্রথম দিন কথা হয় বার্তা সম্পাদক গাজী নাসিরুদ্দিন আহমদ খোকনের সঙ্গে।

শুরুতেই ছোটখাটো একটা ইন্টারভিউ হয়ে গেল। কম্পিউটারে কতটা লিখতে পারি, দিতে হল তার পরীক্ষা।

কম্পিউটারে বাংলা লেখায় আনকোরা হলেও সাংবাদিকতায় আমি একবারে নতুন নই তখন। ফকিরাপুল থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনতায় কাজ করে ততদিনে ঝুলিতে জমেছে ২৩ মাসের অভিজ্ঞতা। তারও আগে প্রদায়ক হিসাবে কাজ করেছি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন জনতার চোখে।

সেসব দিনে হাতে লিখে জমা দিতে হত প্রতিবেদন। এখন পেছনে ফিরে তাকালে বিস্ময় মানি, কত দ্রুত ডিজিটালাইজড হয়েছে বাংলাদেশ, কেমন করে এই দেশ আমাদের চোখের সামনেই বদলে গেছে!

২০০৭ সালে আমরা যখন ক্যাম্পাসে এসেছি, তখন সংবাদমাধ্যমে 'ক্যাম্পাস হিরো'র বিজ্ঞাপন দিত সিটিসেল। সেই ক্যাম্পাস হিরো ছিলেন ল্যাপটপওয়ালা এক ছাত্র।

এখনকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা হয়ত ভাবতেই পারবে না, একটা ল্যাপটপ থাকলেই ক্যাম্পাসের হিরো বনে যাওয়া যেত সে সময়। সেসব দিনে শিক্ষার্থীরা বিভাগের অ্যাকাডেমিক অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিত হাতে লিখেই। কম্পোজ করে দিতে হলে সে কাজ সারতে হত নীলক্ষেতে।

যে সময়ের কথা বলছি, তার ঠিক আগের বছর বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসে নতুন এক যুগের সূচনা হয়।

২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে সংবাদ সংস্থা বিডিনিউজের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা বদলে যায়। সাংবাদিক ও বিবিসির সাবেক ব্রডকাস্টার তৌফিক ইমরোজ খালিদী দায়িত্ব নেওয়ার পর অসামান্য পরিবর্তন নিয়ে আসেন। সেই প্রথম বাংলাদেশের কোনো বার্তাকক্ষে ২৪ ঘণ্টার কর্মপরিবেশ তৈরি হতে থাকে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম হিসেবে শুরু হয় সংবাদমাধ্যমটির নতুন পথচলা।

শুরুতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সংবাদ পড়তে পারতেন কেবল গ্রাহকরাই। ওই বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে তাও বদলে যায়। সরকারি ছুটির মধ্যে ছাপা সংবাদপত্রগুলোও যখন ছুটিতে, তখন অনন্য এক সিদ্ধান্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সব সংবাদ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এখনও পাঠকের জন্য একই রকম উন্মুক্ত। আজ ২০১৬ সালে এসে যখন অনলাইনে নিউ ইয়র্ক টাইমস পড়তে মাসে মাসে ডলার গুনতে হয়, তখন এক দশক আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সেই সিদ্ধান্তের কথা ভাবলে অবাকই লাগে।

সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রদায়ক হিসেবে লিখে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হলেও তখনও এই পেশা থেকে অর্থকড়ির মুখ দেখিনি। ২০০৭ সালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করার পর দৈনিক জনতায় চেষ্টা শুরু করলাম। কিন্তু জনতার তখনকার চিফ রিপোর্টার বিব্রত ভঙ্গিতে প্রথম দিন আমাকে ফিরিয়ে দিতে চাইলেন।

দিনের পর দিন তার কাছে বসে থাকতে থাকতেই এল ঘূর্ণিঝড় সিডর। জনতার জনবল সংকটে কাজ করার সুযোগ পেয়ে গেলাম আমি। কয়েক মাসের মধ্যে স্থির হলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে। তবে প্রথম দিনই জানিয়ে দেওয়া হল, টাকা-পয়সা 'বেশি' পাওয়া যাবে না।

ঢাকার নামি অনেক সংবাদমাধ্যমেও সে সময় কর্মীদের বেতন নিয়ে নানা ছলচাতুরি চলত। জনতায় বেতন নামে মাত্র হলেও তেমন বাজে অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়নি। যৎসামান্য যা দিত, মাস শেষ হলেই তা পাওয়া যেত।

জনতায় কাজ শুরুর কয়েক মাস পর একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ অফিসে বসে একাগ্র চিত্তে কাজ করতে থাকা এক আপুর দেখা পেলাম। পরিচিত হতে চাইলাম, কিন্তু ব্যস্ত আপু কথা বললেন না। কোন খবর লিখছেন দেখতে চাইলাম; বললেন, "একটু পর ওয়েবসাইটে উঠে যাবে, তখনই দেখে নিও।"

কোথায় কাজ করেন? কোন সাইটে উঠবে? বেলা ১১টায় নিউজ লেখার এত তাড়া কেন? কিছুই বুঝতে পারলাম না। মনে মনে তাকে অহংকারী ভেবে কষ্ট চাপা দিলাম।

দুদিন পর রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে তার সঙ্গে আবার দেখা। আমি তাকে দেখেও অন্যদিকে চলে যেতে চাইলাম। কিন্তু এবার তিনিই আমাকে ডাকলেন। অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। কোনো রকমে উৎরে গেলাম।

তখন বুঝতে পারলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাজের ধরন অন্যদের চেয়ে আলাদা। যখন ঘটনা, খবর তখনই। সে অভিজ্ঞতা আমার পত্রিকায় হয়নি।

জান্নাতুল ফেরদাউস তানভী আপুর মতো আমিও সক্রিয় হতে চাইলাম। তখনও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে কাজ শুরু করিনি, কিন্তু প্রভাবিত হওয়ার শুরুটা তখনই। ক্যাম্পাসে কোনো ঘটনা ঘটলে তখনই আমি ঘটনাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। অবশ্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম দেখার সুযোগ তখনও আমার ছিল না।

জনতায় তখন ইন্টারনেট ছিল কেবল একটি কম্পিউটারে। ক্যাম্পাসের বাইরের ঘটনা নিয়ে লিখতে হলে বসদের কেউ কখনো কখনো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রিন্ট আউট ধরিয়ে দিতেন।

২০০৯ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে যোগ দেওয়ার জন্য যেদিন জনতা থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিতে গেলাম, সেদিন দেখলাম রিপোর্টিং বিভাগে কয়েকটি কম্পিউটার লেগেছে। বড় আফসোস হল, আর কিছুদিন আগে এই কম্পিউটারগুলো এলে আমিও কাজ করার সুযোগ পেতাম।

২০০৯ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে কাজ শুরুর পর হঠাৎ করেই বদলে যায় আমার পৃথিবী। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠি। সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল, কোনো ঘটনা আমরা যেভাবে লিখতাম, অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম তা অনুসরণ করত।

দিনভর মাঠে থাকার অভ্যাসের কারণে অন্য অনেকের চেয়ে সুনির্দিষ্টভাবে ঘটনা তুলে আনায় দক্ষ হয়ে উঠছিলাম তখন। কয়েকবার দেখেছি, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংবাদ লিখতে গিয়ে কারও কারও প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আমার প্রথম বছর ২১ ফেব্রুয়ারি একাই কভার করি। রাত গড়িয়ে সকাল হয়, লেখা হয় অনেক রিপোর্ট। কিছু ওয়েবসাইটে ওঠে, কিছু সম্পাদকীয় টেবিলে আটকে যায়। সেগুলো আবার দেখি, বুঝতে চেষ্টা করি কেন আটকাল।

তবে যখন দেখা তখন লেখা, আর অল্প সময়ের মধ্যে তা অনলাইনে ছাপার অক্ষরে দেখার আনন্দ ছিল অন্যরকম। তখনও আমার ব্যক্তিগত ল্যাপটপ বা কম্পিউটার ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদকের প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও নিজের লেখা দেখার জন্য প্রতিদিনই অফিসে যেতাম।

এভাবে চলল বেশ কিছুদিন। প্রতিবেদক হিসেবে চাকরিতে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টায় টানাপড়েনের মধ্যে এক সময় অফিসে যাওয়া-আসা বন্ধ করে দিলাম। কিছুদিন পর দাবি পূরণ হয়, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ফিরি নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে।

কাজের আগ্রহ জানতে চাইলে প্রথমে জ্বালানি, পরে পরিবেশের কথা বলেছিলাম। তবে তখনও মাস্টার্স শেষ না হওয়ায় সব দিক বিবেচনা করে ঠিক হয়, আমার কাজ হবে সুপ্রিম কোর্টের খবর সংগ্রহ।

২০১১ সালের জানুয়ারির শুরুতে জীবনে প্রথমবার দেশের সর্বোচ্চ আদালতে যাই। সে যেন এক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার। সর্বোচ্চ আদালতে ফতোয়ার মামলা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মামলা, ড. ইউনূসের মামলার মতো আলোচিত ঘটনাগুলো দেখা এবং সেসব নিয়ে প্রতিবেদন লেখার অভিজ্ঞতা যেমন হয়েছে, তেমনি আদালতে থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখার বিরল সুযোগ পেয়েছি আমি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে কাজের সুযোগ পড়াশোনার ক্ষেত্রেও ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিয়েছে। সম্মান চতুর্থ বর্ষে যখন 'অনলাইন সাংবাদিকতা' নামের একটি কোর্স পড়ানো হচ্ছে, ততদিনে আমি নিজেই অনলাইনের সাংবাদিক। মাস্টার্সে যখন উচ্চতর রিপোর্টিং ক্লাসে 'কোর্ট রিপোর্টিং' পড়ানো হচ্ছে, তখন আমি উচ্চ আদালতের রিপোর্টিংয়ের গরম গরম অভিজ্ঞতা নিয়ে ক্লাসে গিয়েছি।

আমার সাংবাদিকতা পড়তে এবং সাংবাদিকতা করতে আসা পরিবারের পছন্দ ছিল না। বাড়িতে গেলেই সাংবাদিকতা ছাড়ার পরামর্শ শুনতে হত বলে বাড়ি যেতাম কম। বছর ঘুরত, ঈদ-পূজা-গ্রীষ্ম সব ছুটিই আমার কাটত ক্যাম্পাসে আর অফিসে।

এরপর অনেক বদলের মধ্য দিয়ে অনেক নতুনের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ। নতুন অনেক ধারণা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে চালু করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমও দশ বছরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। নিজেকে বারবার নবায়িত করার প্রতিশ্রুতি আর এগিয়ে থাকার প্রত্যয় নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পাঠকের সংবাদমাধ্যম।

সুলাইমান নিলয়
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক