সাংবাদিকতার পালাবদলের দশক

rifaat newaz
Published : 30 Oct 2016, 04:00 PM
Updated : 30 Oct 2016, 04:00 PM

"It is not merely of some importance but is of fundamental importance, that justice should not only be done, but should manifestly and undoubtedly be seen to be done."

— Lord Chief Justice Hewart

এক.
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছরের শুরু থেকেই রাজনৈতিক শিবিরগুলোতে নানা তৎপরতা। সংবাদমাধ্যম বলতে কাগজে ছাপা পত্রিকা। বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে নির্বিষ রিপোর্ট। এখনকার মতো তখনকার টেলিভিশন স্টেশনগুলোর মালিক ছিল সরকারের পছন্দের লোকেরা। পত্রিকাগুলিতে নানা স্পেকুলেটিভ খবর ছাপা হয়। ওদিকে সিভিল সোসাইটি নামের এনজিও নেতৃত্ব তৎপর। যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের প্রচারের নামে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক ছোটাছুটি চলছে তাদের। তাদের সঙ্গী হয়েছেন খণ্ডকালীন কিন্তু মিডিয়াডার্লিং বলে পরিচিত কয়েকজন রাজনীতিবিদ। ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকরাও ভীষণ সরব। নিয়ম করে তারা দলবেঁধে মিডিয়ার সামনে আসেন। প্রকাশ্যে-গোপনে সভা করেন। প্রধান বলে পরিচিত একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিকে ঘটা করে বিদেশিদের উদ্বেগ ও পরামর্শের খবর প্রকাশিত হয়। সিভিল সোসাইটিওয়ালাদের পোয়াবারো। ওই দুই পত্রিকা যেন তাদের মুখপাত্র। নিউজে-ভিউজে তাদেরই রমরমা। রাজনীতির এই ঘনঘটায় অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিল সরকার। এমন এক নির্বাচন কমিশন তারা নিয়োগ দিল যাদের পাথেকে নখ পর্যন্ত বিতর্কিত। দেড় কোটি ভুয়া ভোটার নিবন্ধন করে নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করল তারা। পত্রিকাগুলোর মনগড়া-কাল্পনিক রিপোর্টে জনবিভ্রান্তি চরম পর্যায়ে।

দুই.
নিবন্ধ লেখক তখন বড় বাজেটের নতুন একটি বাংলা পত্রিকায় কাজ করেন। ওই পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যার প্রধান শিরোনাম ছিল: "থার্ড ফোর্স ক্ষমতায় আসছে না।" বলাবাহুল্য, ওই প্রতিবেদনের সূত্র ছিল অজ্ঞাত। এবং প্রতিবেদনটি ছিল উদ্দেশ্যমূলক। সব পত্রিকাতেই এমন অজানা সূত্রের বরাতে নানা খবর বের হয়। পাঠক খবর পড়েন আর বিভ্রান্ত হন। বাংলাদেশের পাঠকের জন্য এমন বিভ্রান্তি নতুন নয়।

তিন.
সংবাদের নামে প্রচারণা আর মনগড়া-বানোয়াট খবরের নিরুপায় ভোক্তা বিপুলসংখ্যক পাঠকগোষ্ঠী। ইত্তেফাকে প্রকাশিত ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কালে জালপরা বাসন্তীর ছবি তো দুর্ভিক্ষের আইকনিক ছবি হয়ে গেছে। এখন সবাই জানেন, সেটি বানোয়াট ছিল। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত দেশের প্রধান পত্রিকা ইত্তেফাকের কথাটা আবার একটু বলি। অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আফগান মুজাহিদদের দীর্ঘদিনের যুদ্ধ নিয়ে মজার একটা গল্প প্রচলিত আছে। বলা হয়, ওই যুদ্ধে যতজন সোভিয়েত সৈন্যকে ইত্তেফাক মেরেছিল গোটাসোভিয়েত বাহিনীতেই তত সৈন্য ছিল না। ইরাক যুদ্ধ বা আফগান যুদ্ধের খবরাখবর প্রকাশে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলির লড়াইয়ের কথাও মনে আছে। সাদ্দাম হোসেনের পতনের আগের দিনও ঢাকার যুগান্তর পত্রিকা ফ্রন্ট পেইজে গ্রাফিক্স করে পতিত ইরাকি প্রেসিডেন্টের চার স্তরের নিরাপত্তা কেমন তা প্রকাশ করেছিল। ইরাকি রিপাবলিকান আর্মির এমন নিরাপত্তা ব্যূহ যদি থাকতও, তাতে এমন নিরাপত্তা সিক্রেট ফাঁস কিভাবে যুগান্তর করেছিল তা বিস্ময়কর। এমন ভাবাটা খুব অমূলক হবে না যে, ওই গ্রাফিক্স হাতে পেয়ে মার্কিনবাহিনী একদিনেই ধসিয়ে দেয় ইরাকি বাহিনীকে! ঢাকার পত্রপত্রিকার এমন উদাহরণ দিতে গেলে আরব্য রজনীর গল্প হয়ে যেতে পারে। সামরিক সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল, তথ্যবিকৃতি ও প্রচারণা কী পর্যায়ে ছিল, আজকের নবীন পাঠকের পক্ষে তা ভাবা মোটামুটি অসম্ভব।

চার.
স্বাধীনতা-উত্তরকালে কবি আল-মাহমুদ সম্পাদিত গণকণ্ঠের পাতায় পাতায় ছাপা তথাকথিত খবর রাজনীতিতে অনেক মিথ তৈরি করেছে। যে মিথ এখনও ভাঙেনি। যেমন, ৩০ হাজার জাসদ নেতাকর্মীকে হত্যা। স্বল্প প্রচারের হলেও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর হককথার বিরুদ্ধেও প্রচারণা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একদা আওয়ামী লীগ মুখপাত্র ইত্তেফাক, গণকণ্ঠ, হককথার রাজনৈতিক ভূমিকার বিপরীতে ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানার দৈনিক বাংলা, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণিপ্রতিষ্ঠিত বাংলার বাণী, আরেক সরকারি মালিকানার পত্রিকা বাংলাদেশ টাইমসের রাজনৈতিক ভূমিকা। স্বাধীনতাবিরোধী হামিদুল হক চৌধুরীর ইংরেজি পত্রিকা অবজারভারের প্রখ্যাত সম্পাদক আবদুস সালাম ১৯৭০-এর পার্লামেন্টের বৈধতার প্রশ্ন তুলে দেশদ্রোহিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। একদা নামজাদা সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরীর সংবাদ পত্রিকা বামপন্থীদের পত্রিকা বলেই পরিচিত ছিল। বলা যেতে পারে, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম থেকেই রাজনৈতিক বিশ্বাসের অধীনেই চলেছে সম্পাদকীয় নেতৃত্ব। এক পর্যায়ে বাকশাল গঠনেরসময় মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা নিষিদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু সরকার। ৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিকতন্ত্রের অধীনে সরকারি-বেসরকারি সব পত্রিকাই সামরিক ফরমান মেনে চলতে বাধ্য ছিল। পত্রিকায় কী লেখা হবে না-হবে তার ফরমান আসত সেনানিবাস থেকে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল অপার্থিব বস্তু। কেউ কেউ সাপ্তাহিক বিচিত্রার জনপ্রিয়তার কথা আজকাল বললেও পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে তাদের মুন্সিয়ানা কতটুকু ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতাদখলের পর পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হয়। তবে সাপ্তাহিক পত্রিকার সাহস কিছুটা চোখে পড়ে আশির দশকের এই একনায়ক জেনারেলের আমলে। যায়যায়দিন, বিচিন্তার মতো সাপ্তাহিক এরশাদবিরোধী অবস্থান নিয়ে পাঠকপ্রিয়তা পেলেও মূলত একটিভিজমই ছিল তাদের মূল উপজীব্য। অবশ্য ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এবং এর পূর্বে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সমাজের সাহসী ভূমিকা নন্দিত হয়েছে। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রামেও সাংবাদিক সমাজ সাধুবাদ পাওয়ার মতো ভূমিকা রাখে।স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯১ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত একটিভিজম ও কাউন্টার একটিভিজমই ছিল বাংলাদেশের সংবাদপত্রের মূলধারা। সামরিক শাসনের অবসানের পর নব্বইয়ের দশকে সরাসরি রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিভূ সংবাদপত্রগুলি জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। পেশাদারিত্বের প্রতিশ্রুতি রেখে বাজারে আসা নতুন সংবাদপত্রগুলি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তবে নতুন সংবাদপত্রে আসা বিনিয়োগ যে ধোয়া তুলসীপাতা ছিল তা বলা যাবে না। তাই প্রতিশ্রুতির পুরোটা রক্ষা তারা করতে পারেনি। নব্বইয়ের দশকজুড়ে সংবাদপত্রপ্রকাশের আর বন্ধ হবার হিড়িক পড়ে রীতিমতো। অসাধু পুঁজি, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ও সমাজে প্রভাব তৈরির আকাক্সক্ষা সর্বোপরি গণতন্ত্রের মোড়কে সামরিকতন্ত্রের অবশিষ্টাংশ সাংবাদিকতার বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যে বাস্তবতা থেকে বাংলাদেশ এখনো নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে নেই।

পাঁচ.
এরই মধ্যে সংগঠিত পুঁজির প্রবেশ ঘটে সংবাদপত্রশিল্পে। রাজনৈতিক আদর্শবাদিতার খোলস ঝেড়ে পশ্চিমা ধারার পেশাদারিত্বের অনুকরণ দেখা যেতে শুরু করে সংবাদপত্রশিল্পে। বিষয়বৈচিত্র্যের পাঠক ধরার চেষ্টা দেখা যায়। ততদিনে মিডিয়া ল্যান্ডস্কেপ বদলে যেতে শুরু করেছে। বেসরকারি মালিকানায় টেলিভিশন স্টেশন চালু হয়েই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। সাংবাদিকরা সেলিব্রিটি হতে শুরু করে। অর্থনৈতিক সংস্কারের কারণে বেসরকারি খাতের গুরুত্ব বাড়তে থাকে; পুঁজি সুসংগঠিত হয়। যার প্রভাব আমরা দেখবসংবাদপত্রশিল্পে; বড় কয়েকটি শিল্প ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে এই শিল্পে বিনিয়োগ করতে। তাদের অনেকে যে ভুঁইফোড় নয় তাও বলা যাবে না। প্রতিযোগিতার ধরন দেখে তাদের বাজারমুখী প্রবণতাটা বোঝা যেতে পারে। বাজারমুখী প্রবণতার বাইরে অসাধু মালিকরা নিজ স্বার্থে মিডিয়া মাসল প্রদর্শন করতে থাকে। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে আমরা যেমন এই ঘটনা দেখব তেমনি বেসরকারি টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম দেখব না।

ছয়.
বেসরকারি গণমাধ্যমের প্রভাব বিস্তৃত হওয়ায় এর নানা ধরনের স্টেকহোল্ডার তৈরি হতে থাকে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে এসে জাতিসংঘের উদ্যোগে সরকারের বাইরে অসরকারি সংস্থা ও সমিতিগুলো সংগঠিত করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমান্তরাল ক্ষমতাবলয় তৈরির প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে তাদেরকে ক্ষমতায়িত করার বিদ্যায়তনিক নিরীক্ষা চলে। মূলত সত্তরের দশকে সূচিত নব্য উদারনীতিবাদ বা নিও-লিবারেল তত্ত্বের চূড়ান্ত পরীক্ষা ছিল সেটি।বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছন্নছাড়া সিভিল সোসাইটির প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় সংবাদপত্র। উপনিবেশজাত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবশেষ তাতে কল্কে পায়। সিভিল সোসাইটির কর্তৃত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রবলতর হয়ে ওঠে। প্রতিপত্তিশালী সেনাবাহিনী ও সিভিল সোসাইটির নতুন প্রভাববলয় বিকাশমান গণতন্ত্রের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বাংলাদেশে নিও-লিবারেলিজমের পোস্টার বয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসেরযূথবদ্ধতা অদৃশ্য একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির সূচনা করে বলে নিবন্ধ রচয়িতার ব্যক্তিগত ধারণা। সেই সময় ড. ইউনূসের প্রচারিত 'আমার স্বপ্নের দল' বক্তব্যটি সিভিল সোসাইটির গোপন রাজনৈতিক ইশতেহার হিসেবে কাজ করেছে বলে তাদের পরবর্তী কর্মতৎপরতায় প্রতীয়মান হয়। ধান ভানতে শিবের গীতের মতো শোনালেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট ও সমস্যাকে চিহ্নিত করতে না পারলে পেশাদার গণমাধ্যমের অগ্রযাত্রার বাধাসমূহকেও চেনা সম্ভব হবে না।

সাত.
রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে-বাইরে সমূহ বিপদ সামনে রেখে অসম বাজার ব্যবস্থায় একটি মুক্ত ও জনস্বার্থমুখী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা অলীক স্বপ্ন বৈ কিছু নয়। ১৯৯৬ সালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সিভিল সোসাইটির যোগসাজশে অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে এসে তার শক্ত পটভূমি রচনা করা সম্ভব হয়। অনিবার্য ব্যর্থ রাজনৈতিক সংলাপ, রাজপথের রক্তক্ষয়ী সহিংসতা সংবিধানের ফাঁক গলে সেরিমোনিয়াল রাষ্ট্রপতির সরকারপ্রধানের পদে আরোহণ ও জনমনে ঘোর অনিশ্চয়তার সুযোগকে কাজেলাগিয়ে সেনাবাহিনী বেসামরিক মুখোশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। তারই কিছুকাল আগে, ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসের অনিশ্চিত সেই দিনগুলোর একদিন ২৩ অক্টোবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম উৎসুক পাঠকের জন্য তার সমস্ত কন্টেন্ট উন্মুক্ত করে দেয়। যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম ইন্টারনেট সংবাদপত্রের।

আট.
বার্তা সংস্থা বিডিনিউজের জন্ম অবশ্য আরো আগে। ২০০৫ সালের প্রথমার্ধে। এ সময় টেলিপ্রিন্টারের বদলে গ্রাহকদের কাছে ইন্টারনেটে সার্ভিস বিক্রি করত সংবাদ সংস্থাটি। দুই বছর পর ২০০৬ সালের জুন মাসে এসে এর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা পুরো বদলে যায়। বার্তা সংস্থাটি নতুন নাম নেয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। স্বত্বাধিকারী কোম্পানি বাংলাদেশ নিউজ টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স লিমিটেডের মালিকানা হস্তান্তর হয়। পরিবর্তিত মালিকানায় কোম্পানির চেয়ারম্যান হন উদ্যোক্তা ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ী আসিফমাহমুদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিক ইমরোজ খালিদী। শুরু থেকেই এ দুইজন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। বর্তমানেও তারা দুজনই বোর্ড পরিচালনা করেন। পরিচালনা পর্ষদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তে কোনোরূপ পরামর্শ, আদেশ, নিষেধ বা হস্তক্ষেপের অধিকার রাখে না। দেশ-বিদেশের নানা গণমাধ্যমের নানা পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী প্রশিক্ষিত সাংবাদিক ও সম্প্রচারক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক। সংবাদমাধ্যমকে পরিচালনা পর্ষদেরহস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গত ১০ বছর ধরে নিউজ অপারেশনে এ রকমের কোনো সমস্যার মুখোমুখি এখানে কর্মরত কোনো সাংবাদিক হননি বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কর্তৃপক্ষ দাবি করে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে এটি অনন্য ঘটনা।

নয়.
২০০৬-এর অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০০৭-এর জানুয়ারির ১১ তারিখ সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণে খবর জন্ম নিত। বেশির ভাগ খবরই হত অনানুষ্ঠানিক উৎস থেকে। খবরের ফাঁকে ফাঁকে ছিল গুজব আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভ্রান্তি। সেসব ছেঁকে সত্যাশ্রয়ী খবর বের করে আনা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। তার ওপর সারাক্ষণ খবর উৎপাদন। দেশে তখন ২৪ ঘণ্টার সার্বক্ষণিক বার্তাকক্ষও নেই। আজকাল টিভিতে যে স্ক্রল বা টিকার দেখা যায় তখন তার চর্চা বেসরকারি স্টেশনগুলোতেও চালুহয়নি। টিভি বুলেটিনে সরকারি আনুগত্য রাখতে গিয়ে জরুরি খবরও প্রকাশ করত না কেউ। আছে টেলিভিশন সাংবাদিকতার মাধ্যমগত সমস্যা। ফুটেজ/বাইট সহজলভ্য ছিল না। লাইভ হত কদাচিৎ। ছাপার পত্রিকায় পাওয়া যায় বাসি হয়ে যাওয়া খবর। শুধু বাংলাদেশ কেন, গোটা বিশ্বেই তখন শুধু-ইন্টারনেটভিত্তিক নিউজ অপারেশন নেই। দুনিয়াতে ইন্টারনেটে সংবাদ দেওয়ার ঘটনা খুব পুরনোও না। ১৯৯৮ সালে শুরু হয় এর চর্চা। ইন্টারনেট মাধ্যম হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিত তখন হাফিংটন পোস্ট। তবে সেখানে সার্বক্ষণিকখবর পরিবেশন করা হত না। এটি ছিল ব্লগধর্মী ওয়েবসাইট। বিশ্বেই যেখানে ক্ষণে ক্ষণে খবর খুব সুলভ কিছু নয় সেখানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রতি মুহূর্তের সংবাদের প্রতিশ্রুতি পূরণের কারণে মাত্র কয়েক সপ্তাহেই সাড়া ফেলে দিতে সক্ষম হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ওয়েবসাইটে খবর প্রকাশের পাশাপাশি উদ্ভাবনী দক্ষতা দিয়ে আমরা মোবাইল ফোনেও খবর সম্প্রচার শুরু করি। নির্দিষ্ট একটি পোর্টে ডায়াল করে তাৎক্ষণিক খবর শোনার প্রবল তথ্যক্ষুধা মেটানো যেত। দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশিনতুন মিডিয়ার বেঁচে থাকার জন্য সঞ্জীবনীর কাজ করেছে এই সংবাদসেবা। খবর সম্প্রচার ছাড়াও বিশ্বে প্রথমবারের মতো মোবাইল টেলিফোনে এসএমএসের ১৬০ ক্যারেক্টারের সীমার মধ্যে পুরো একটি সংবাদ প্রকাশের উদ্ভাবনও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে। দেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটরের অংশীদারিত্বে খুদে বার্তায় সংবাদের অ্যালার্ট সার্ভিস বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এই অ্যালার্ট সার্ভিস এতই জনপ্রিয় হয় যে, এর গ্রাহকসংখ্যা এক পর্যায়ে দেশের সব বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্মিলিত প্রচার সংখ্যারদেড় গুণ হয়। খবরকে এত সুলভ করে দিয়ে মানুষের তথ্যক্ষুধা নিবৃত্ত করা এবং নিউজ কনসাম্পশন বাড়াতে এক দশক আগে পথিকৃতের ভূমিকা রাখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। সংবাদ ভোক্তাদের পুরনো রুচি ও স্বাদ বদলের শুরু হয়।

দশ.
ক্ষুদ্র বাংলাদেশে হাজার হাজার জাতীয় স্থানীয় সংবাদপত্র আর নিউজ পোর্টাল। অসংখ্য টেলিভিশন। আছে রেডিও। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য বা ক্রেডিবল মিডিয়া কয়টি? নাম না জানা সূত্র ও অনুমানের বরাতে এখন যেমন খবর বের হয় প্রখ্যাত ও অখ্যাত সংবাদমাধ্যমে, ২০০৬-০৮-এর সেই রাজনৈতিক দুর্যোগকালে তা ছিল বহুগুণে। সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট সিভিল সোসাইটির সমর্থক পত্রিকা দুটি তো বটেই, দেশের প্রায় সব মিডিয়া অজ্ঞাত সূত্রের বরাতে গোয়েন্দাদের সরবরাহ করা রাজনীতিবিদদের চরিত্রহননমূলক খবর ছাপাত।সম্প্রতি দুই দৈনিকের একটি ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম সে রকম খবর প্রকাশের দায় নিয়ে প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করেছেন। সে সময় এ ঘটনা ঘটেছে আকছার। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বানানো খবর প্রকাশ করে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে মামলা হত, মামলাবিহীন গ্রেপ্তার করা হত। এই যখন ছিল অবস্থা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদকীয় ব্যবস্থাপনা নামবিহীন কোনো সূত্রের বরাতে কোনো খবর প্রকাশ করেনি। জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে নির্যাতনের মাধ্যমে সেনা গোয়েন্দাদের আদায় করা মনগড়া তথ্য আমরাপ্রকাশ করিনি। প্রকাশের জন্য চাপ থাকলেও তা অনেক মূল্যে আমরা সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি। তার পরও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে এমন কিছুতে নত হইনি আমরা। প্রতিটি সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রেই স্বীকৃত পেশাদার সম্পাদকীয় মান বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলাম আমরা।

২০০৭ সালেই এই পেশাগত দৃঢ়তার জন্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম দেশের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যম হিসেবে দেশ-বিদেশের পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। ২০০৮ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এক অনুষ্ঠানে প্রধান সম্পাদকের সঙ্গী হয়ে যাবার সুযোগ হয় এই নিবন্ধকারের। ওই বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান তার ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, "এরা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার চেহারা বদলে দিয়েছে।"

এগার.
শিরোনামের ওপরে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এই নিবন্ধের অবতারণা করেছিলাম। উক্তিটি বিশ শতকের প্রথমার্ধের ইংল্যান্ডের একজন প্রধান বিচারপতির। ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করার চেয়ে ন্যায্য বিচার কিভাবে নিশ্চিত করা হচ্ছে সেই স্বচ্ছতার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বিখ্যাত এই বিচারক। অর্থাৎ বিচারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। কথাটা সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রেও খাটে। আপনার পরিবেশিত খবরটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা বিচার করবেন পাঠক। খবরে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভাষ্য বা পাল্টা ভাষ্য থাকে, তথ্যেরপ্রাসঙ্গিক সন্নিবেশ, প্রতিবেশের সৎ উপস্থাপনা, জটিলতামুক্ত ও অস্পষ্টতামুক্ত ব্যাখ্যা থাকে, তবে পাঠক নিজেই বুঝতে পারবেন খবর কি বস্তুনিষ্ঠ নাকি খণ্ডিত।

গাজী নাসিরুদ্দিন আহমদ খোকন
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স প্রধান ও সম্পাদকীয় নীতি সমন্বয়ক