সংবাদপত্রে প্রযুক্তি বিবর্তন

rifaat newaz
Published : 30 Oct 2016, 01:00 PM
Updated : 30 Oct 2016, 01:00 PM

আমার স্কুলজীবন কেটেছে গ্রামে। ঠিক অজ গ্রাম বলা যাবে না, তুলনামূলকভাবে ওই সময়ের আলোকিত গ্রামই বলতে হবে। আলো জ্বেলে রেখেছিল আমি যে হাইস্কুলটায় পড়তাম, সে স্কুলটাই। পত্রিকা আসত স্কুলে, প্রতিদিন দুটি বাংলা 'দৈনিক আজাদি' আর ইংরেজি 'পাকিস্তান অবজারভার' (স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ অবজারভার। বর্তমানে বন্ধ)। তবে দিনের পত্রিকা দিনে যেত না, যেত একদিন পর। দুপুরের ডাকে পোস্ট অফিসে, তারপর স্কুলে। শিক্ষকরা যেন উন্মুখ হয়ে থাকতেন। কতক্ষণে কার পালা, তাই নিয়ে অপেক্ষা। আমার মতো কয়েকজন উপরের ক্লাসের ছাত্র ঘুর-ঘুর করত আশেপাশে। সুযোগ পেলেই এক ঝলক দেখ নিতাম স্যারদের অনুমতি নিয়ে। পত্রিকার প্রতি আকর্ষণ থাকলেও সাংবাদিকতা পেশা সম্পর্কে কিছু জানা ছিল না। যখন জানলাম তখন সাংবাদিকতা পেশার প্রতি ঔৎসুক্য জন্মাল। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের এত খবর কেমনে সংগ্রহ করা হয়, লেখা হয়, কিভাবে ছাপা হয়, মনে ইত্যাদি প্রশ্ন।

গত দুই যুগে বিপ্লব ঘটেছে তথ্যপ্রযুক্তিতে। তথ্যপ্রযুক্তির এই পরিবর্তন বিপ্লব ঘটিয়েছে মিডিয়া ও মুদ্রণশিল্পেও। এক সময় মিডিয়া বলতে প্রধানত সংবাদপত্র বা প্রিন্ট মিডিয়াকেই বোঝাত। সময় বদলে গেছে। প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য এখন ক্ষয়িষ্ণু যুগ। মিডিয়ার প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া। সংবাদপত্র বলতে এখন আর কেবল নিউজপ্রিন্টে মুদ্রিত পত্রিকা বোঝায় না, নিউজপ্রিন্ট ছাড়াও সংবাদপত্র হয়, অনলাইন সংবাদপত্র। মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে অনলাইন সংবাদপত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত সংবাদপত্রের বিবর্তনের ইতিহাসও কম বিস্ময়কর নয়।

কম্পিউটারের সামনে বসে আজকের প্রজন্ম ভাবতেও পারবে না সিসার এক-একটা টাইপ কাঠের গ্যালিতে তুলে তৈরি করা হত এক-একটা শব্দ, এমনি শব্দের পর শব্দ যোগ করে তৈরি হত বাক্য। এভাবে টাইপের পর টাইপ সাজিয়ে কম্পোজ করা হত এক-একটা খবর। তারপর সেগুলো বড় একটা গ্যালিতে মেকআপ করে প্রস্তুত করা হত একটার পর একটা পত্রিকার পৃষ্ঠা। তাতে কালি লাগিয়ে তার উপর সেঁটে দেওয়া হত নিউজপ্রিন্ট। আস্ত একজন মানুষ তাতে পায়ের চাপ দিয়ে তুলত প্রুফ। এরপর আবার কালি মেখে তা ছাপা হত প্রেসে। তখন যারা প্রেসে কাজ করতেন, মেশিনম্যান হোক, আর কম্পোজিটর হোক, তাদের জীবনটাই কেটেছে ধুলো-ময়লা-কালির মধ্যে। সে কালির ছাপ সাংবাদিকদের গায়েও পড়ত।

সংবাদপত্রে প্রযুক্তির পরিবর্তন নির্বিবাদে হয়নি। কম্পিউটারের প্রবেশ ঘটেছে দীর্ঘ হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে। কারণ প্রযুক্তি পরিবর্তন সঙ্গে এনেছে বেকারত্বের হুমকি, যা যুগে-যুগে প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গেই ঘটেছে। কম্পিউটারে কম্পোজ হলে স্বল্প-শিক্ষিত প্রেস শ্রমিকদের ভাগ্য কী হবে? বেকারত্ব ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে কাজ করতে হত বলে প্রেস শ্রমিকরা ছিলেন বেশ সংগ্রামী, তাদের ইউনিয়ন ছিল শক্তিশালী। সে সময় সংবাদপত্রের তিনটি ইউনিয়নের (সাংবাদিক, প্রেস শ্রমিক ও সাধারণ কর্মচারী) মধ্যে প্রেস শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল সবচেয়ে সংগঠিত ও আপসহীন। কম্পিউটারের আগমনের ধ্বনিতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। কিন্তু কম্পিউটার প্রবর্তনের ব্যাপারে মালিকরা অনড়। কারণ তা বেশি লাভজনক এবং প্রেস শ্রমিকদের বাদ দেওয়া গেলে সংবাদপত্রশিল্প অনেকটা আন্দোলনমুক্ত হবে। ফলে সাংবাদিকসহ সংবাদপত্রে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীরা কম্পিউটার প্রবর্তনের প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়লেন। প্রেস শ্রমিকরা শক্ত আন্দোলন শুরু করে দিলেন। সাংবাদিকরা নতুন প্রযুক্তিকে কমবেশি স্বাগত জানালে তারাও প্রেস শ্রমিকদের ক্ষোভের শিকার হলেন। আমি তখন ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশন-এর বার্তা সম্পাদক। মেক-আপ দেখার জন্য প্রায়ই প্রেসে যেতে হত। একদিন বেরিয়ে দেখি প্যান্টে কখন কালি লেপটে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও সাংবাদিকদের গায়ে হাতও তোলা হয়েছে। যা হোক, সংবাদপত্রে কম্পিউটারের প্রবর্তন একবারে হয়নি, পর্যায়ক্রমে হয়েছে এবং বহু প্রেস শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।

কম্পিউটার প্রবর্তনের ফলে সংবাদপত্রে বৈচিত্র্য এসেছে, প্রকাশনা-প্রক্রিয়ার সময় হ্রাস পেয়েছে, সেই সঙ্গে জনবলও কমে গেছে। আগে খবর পাঠানো হত তিন উপায়ে: পোস্ট অফিস ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে এবং টেলিফোনে। টেলিফোন ছাড়া আর দুটি উপায় এখন বিস্মৃত। কম্পিউটার যুগের আগে দুটো-আড়াইটার আগে সংবাদপত্র ছাপার কথা ভাবা যেত না। বাসায় ফিরতে তিন-চারটা, রাত যখন প্রায় শেষ, ফজরের আজান চলছে। নগরীর রাস্তায় তখন সাংবাদিকদের সাথে দেখা হত কেবল নেড়িকুকুর আর টহলদার পুলিশের। 'বাসায় ফিরে দেখি ভাত ঠা-া, বউ গরম'Ñ একজন সাংবাদিকের জীবনের এটাই ছিল বাস্তবতা। এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েই সেদিন সাংবাদিকতা করতে হত। এখন একজন সাংবাদিকের হাতে মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ থাকলে মনে হয় দুনিয়াটাই তার বগলে। খবর সংগ্রহে যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ দুটোই ব্যবহার করা যায়। টেলিগ্রাম অফিসে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না, দুনিয়ার যেকোনো জায়গা থেকে যখন-তখন খবর পাঠানো মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার।

আমার মতো যাদের সাংবাদিকতার সেকাল-একাল দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তারাই অনুধাবন করবেন পরিবর্তনটা কেমন রাত-দিনের মতো। প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সাংবাদিকতার ধ্যান-ধারণায়ও পরিবর্তন এসেছে। সাংবাদিকতা আর কেবল পেশাদার সাংবাদিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, অপেশাদাররাও এক ধরনের সাংবাদিকতা করছে, যাকে বলা হচ্ছে 'নাগরিক সাংবাদিকতা'। ধরা যাক সিলেটের ছাত্রী খাদিজাকে কোপানোর ঘটনা। কেউ একজন প্রত্যক্ষদর্শী মোবাইল ফোনে ঘটনার ফটো তুলে ছড়িয়ে দিয়েছে ইন্টারনেটে। ওই ছবি প্রিন্ট মিডিয়াতেও ছাপা হয়েছে, প্রদর্শন করা হয়েছে টেলিভিশনেও। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তা পেয়েছে ব্যাপক প্রচার, সেই সঙ্গে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া।

সংবাদপত্র আর নিউজপ্রিন্টে মুদ্রিত সংবাদপত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং অনলাইন সংবাদপত্রের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে নিউজপ্রিন্টে মুদ্রিত সংবাদপত্র। এ চ্যালেঞ্জের মুখে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক প্রতিষ্ঠিত মুদ্রিত সংবাদপত্র সম্পূর্ণ অনলাইন ভার্সনে চলে গেছে। আমাদের দেশেও অনলাইন সংবাদপত্রের দ্রুত বিকাশের ফলে মুদ্রিত সংবাদপত্র চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। অনলাইন সংবাদপত্রগুলোকে মোকাবিলার জন্যই মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলো পত্রিকা প্রকাশের আগে অনলাইন ভার্সন প্রকাশ করছে। একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যে, ঘটনা ঘটার পর মুহূর্তেই সচিত্র খবরটি পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারে। এ প্রতিযোগিতায় মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলো কতদিন টিকে থাকতে পারবে, তা সমাজের দ্রুত পরিবর্তনের দিকে তাকালে অনুমান করা কঠিন নয়।

আমানুল্লাহ কবীর
অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি,
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একজন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক